Saturday, July 25, 2015

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়ক; প্রাণঘাতী ২২ কিমি, ৭ মাসে নিহত ৭১

সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ প্রশাসনবঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের ২২ কিলোমিটার এলাকা দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে
গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে ৩৪টি
দুর্ঘটনায় ৭১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৩ জন। সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সর্বশেষ গত সোমবার মধ্যরাতে সড়কের
মুলিবাড়ী এলাকায় বাসের চাপায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার পাঁচ যাত্রী
নিহত হয়েছেন। আর রোববার ভোরে দুই
বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হন ১৭ জন।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী,
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর থেকে গত ১৭
বছরে এই সংযোগ সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত
হয়েছেন ৪২৮ জন। আহত হয়েছেন কয়েক
হাজার।
বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ, সিরাজগঞ্জ সড়ক ও
জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন
বিভিন্ন সময় এসব দুর্ঘটনার যে কারণগুলো
চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো- দুই লেনের
অপ্রশস্ত সড়ক, বাইলেন না থাকা, অদক্ষ
চালক দিয়ে বিরামহীন গাড়ি চালানো,
নির্ধারিত গতিসীমা না মানা, ওভারটেকিং
এবং নছিমন-করিমনসহ ব্যাটারিচালিত
যানবাহন বৃদ্ধি। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে
প্রতিকারের কোনো পদক্ষেপ দেখা
যায়নি। এই সড়কটি বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের
অধীন।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির
আহ্বায়ক জহুরুল হক বলেন, সংযোগ সড়কটি
চার লেনে রূপান্তর করার জন্য
সিরাজগঞ্জবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন
করে আসছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ
হচ্ছে না। যদি এটা দ্রুত করা না হয়, তাহলে
ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে। কারণ, এই
সড়কে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে,
সেতুটি চালু হওয়ার পর উত্তরবঙ্গের ১৬
জেলাসহ খুলনা বিভাগের ২৪টি জেলা থেকে
স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন
ধরনের প্রায় ১২ হাজার যানবাহন এই সড়ক ও
সেতু দিয়ে চলাচল করছে। দুই ঈদ ও বিশ্ব
ইজতেমার সময় যানবাহনের এ সংখ্যা বেড়ে
প্রায় দ্বিগুণ হয়। গেল ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র
করে গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ২০
থেকে ২২ হাজার যানবাহন এই সড়ক দিয়ে
চলাচল করেছে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেতুর পশ্চিম
অংশের মুলিবাড়ী, কাশেম মোড়
বানিয়াগাতী, কোনাবাড়ী, কড্ডা, ঝাউল
ওভারব্রিজ, চৈরগাতী এলাকায় বেশি
দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুলিবাড়ী,
বানিয়াগাতী এলাকায় গত কয়েক দিনে
চারটি দুর্ঘটনায় ৩১ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের
নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ
বলেন, যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় এই
সড়কটি অপ্রশস্ত। দুই লেনের সড়কে দুই দিকের
গাড়ি মুখোমুখি চলাচল করে। চালকেরা
কোনো নিয়মের তোয়াক্কাই করছেন না।
ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন
আহমেদ বললেন, মহাসড়কের কোথাও কোনো
সতর্কবার্তা নেই। সড়কটি নিয়মিতভাবে
রক্ষণাবেক্ষণও হয় না। সড়ক প্রশস্ত করা,
ডিভাইডার স্থাপন, গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা
নেওয়া, চালকদের বিরামহীনভাবে গাড়ি
চালাতে না দিলে এবং ছাদে যাত্রী
পরিবহন নিষিদ্ধ করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে
কমে আসবে।
জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন,
বিশেষ করে চালকদের অদক্ষতার কারণে
দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। চালকদের বিশেষ
প্রশিক্ষণের আওতায় আনা দরকার বলে মত
দেন তিনি।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের
গতকাল মুলিবাড়ী এলাকায় দুর্ঘটনাকবলিত
স্থান পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি
সড়কটি চার লেনে রূপান্তরের ঘোষণা
দিয়েছেন। পাশাপাশি আগামী দুই মাসের
মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হাটিকুমরুল পর্যন্ত
চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রোড ডিভাইডার
নির্মাণের কথাও বলেছেন তিনি।
তবে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম
কমিটির আহ্বায়ক জহুরুল হক প্রথম আলোকে
বললেন, ‘সড়ক পরিবহনমন্ত্রী এর আগেও
একাধিকবার সিরাজগঞ্জে এসে এই
সংযোগ সড়কটি চার লেনে রূপান্তরের
ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো
কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখছি না।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত রাতে
একাধিকবার থেকে মন্ত্রীর সঙ্গে
যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর
মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাওয়ায় কথা
বলা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের
পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা
গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক
সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই সড়কের
কড্ডার মুখ অনেক আগে থেকেই দুর্ঘটনাপ্রবণ
(ব্ল্যাকস্পট)। তার কারিগরি সমস্যার কিছু
সমাধান করা হয়েছে। টোলপ্লাজার কাছের
গোলচত্বরেও কিছু কাজ করা হয়েছে, যাতে
দুর্ঘটনা কমেছে। এর বাইরে এখন যেসব
দুর্ঘটনা হচ্ছে, সে বিষয়ে গবেষণা হতে
পারে।
তবে অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, এখনকার
দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে
দ্রুত ও কম গতির যানবাহনের একসঙ্গে চলা।
সড়কের আশপাশে অনেক নতুন স্থাপনা ও
আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। এতে কম
গতির গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। আর
দূরপাল্লার গাড়ি এখানে দ্রুত বেগে চলে।
এখন দুর্ঘটনা কমাতে হলে এ এলাকায়
দূরপাল্লার গাড়ির গতি কমাতে হবে, না হলে
কম গতির গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হবে।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির
আহ্বায়ক জহুরুল হক বলেন, কম গতির ছোট
যানবাহনের জন্য একটি বাইলেন সড়ক নির্মাণ
করা জরুরি। কারণ, স্থানীয়দের যাতায়াতের
বিষয়টি অবহেলা করা যায় না।
আলোচিত এই ২২ কিলোমিটার সড়ক বঙ্গবন্ধু
সেতু কর্তৃপক্ষের অধীন। এই সেতু কর্তৃপক্ষের
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম
আজাদ বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে সড়কটি চার
লেনে রূপান্তর করতে প্রায় ৬০০ কোটি
টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া
হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এই প্রস্তাবের
বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করছে।
অনুমোদিত হলে ২০১৮ সালের মধ্যে একে
চার লেনে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। তিনি
বলেন, একই সঙ্গে ছোট ছোট যানবাহন
চলাচলের জন্য বাইলেন সড়ক নির্মাণেও
প্রস্তাব রয়েছে। তাঁর মতে, চার লেনের
পাশাপাশি বাইলেন সড়ক নির্মাণ করা গেলে
এই সড়কে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে।

0 comments:

Post a Comment