৬৮ বছর পর নতুন পরিচয় পেতে যাচ্ছে বাসিন্দারা 'আগত (সামনে) হামরা আর ভারত থাকিল না, হামাক ছিট বাংলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই থাকিল।
হামাক পোলাপান বাংলাদেশের পরিচয়ে বড় হইল। এই সাইনবোর্ডটাত অগো একখান ছবি ইতিহাস করিয়া লও। আগত অরা বড় হইল আর এই দুখস্মৃতির ছবি দেখিল।' নাটকটোকা ছিটমহলের রুখসানা বেগম উঠানের
মাঝে ধান মেলতে মেলতে গলা বাড়িয়ে এমন
অনুরোধ করেছিলেন। সম্মতি পেয়ে নিজেই
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ডেকেডুকে একটি
সাইনবোর্ডের সামনে নিয়ে আসেন একদল
ছোট শিশুকে। কড়া রোদের মধ্যেই ছবি
তোলা হয় তাদের।
কেবল ওই শিশুরাই নয়, গোটা ছিটমহলবাসীর জন্য সত্যি সত্যিই এক ইতিহাস রচিত হলো। ভারতীয় সীমান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হলেও বাংলাদেশের ভেতরে একটি ঘরের
সামনে সাইনবোর্ডে লেখা 'থানা : হলদিবাড়ী,
মহকুমা : মেখলিগঞ্জ, জেলা কোচবিহার'।
বাংলাদেশের ভেতরে থেকেও তারা নিজেদের
বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে পারেনি এতকাল। তবে আজ শনিবার বিকেলের পর থেকে 'পরিচয়হীন ছিটমহলবাসী' পরিচয় পাল্টে বাংলাদেশের ভেতরের সব ছিটমহলের বাসিন্দারা পেছনের সবকিছু ঝেরে ফেলে গলা ছেড়ে বলতে পারবে, 'আমরা বাংলাদেশি'। দীর্ঘদিনের মিথ্যার
ওপর ভর করে জীবনযাপনের যাতনা শেষ হচ্ছে
আজ থেকে। এলাকার বাইরে গিয়ে পরিচয় গোপন করে আর তাদের মানবিক-মৌলিক অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে হবে না। আজ শনিবার
বিকেলে ঢাকায় ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা
চুক্তির অনুসমর্থন দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে
ছিটমহলগুলো ঢুকে পড়ছে ইতিহাসের পাতায়।
দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের পালাবদল
হয়ে ছিটমহলবাসী আগামী দিনে গল্পের মতো
করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বলতে
পারবে ছিটমহল জীবনের ইতিহাস।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে
দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগে
গোটা উপমহাদেশ শাসন করত ইংরেজরা। ইংরেজ
শাসনামলে ভারতের কোচবিহারের মহারাজা এবং
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রংপুরের মহারাজার
জমিদারি থাকায় তাঁদের জমাজমির খাজনা ইংরেজদের
প্রদান থেকে বিরত থাকে। তাই পাক-ভারত বিভক্তির
সময় গঠিত বাউন্ডারি কমিশন এসব জমি বাদ দিয়েই দুই
দেশের সীমানা নির্ধারণ করে। ফলে তৎকালীন
পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দুই দেশের
মহারাজার ১৬২ জায়গায় জমি থেকে যায়। এর মধ্যে
বর্তমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের
কোচবিহার মহারাজের ১১১টি জায়গায় জমি থেকে
যায়। আবার ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের
রংপুরের মহারাজার ৫১টি জায়গায় জমি থাকে। দুই
দেশের মহারাজের ব্যক্তিগত জমি হওয়ার কারণে
কোনো দেশই ওই জমির মালিকানা পায় না।
পরবর্তী সময়ে এসব জমি একেকটি ছিটমহল
হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
ভারতের ছিটমহলগুলোর অবস্থান হলেও এখানকার
নাগরিকরা হয়ে যায় ভারতীয়। একইভাবে ভারতের
অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর নাগরিকরাও
বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে থেকে যায় ভারতের
অভ্যন্তরে। দেশ বিভক্তির আগে কোচবিহারের
মহারাজার প্রজারা জমি চাষ করে তাঁকে খাজনা দিত।
কিন্তু দেশ বিভক্তির পর ভারত সরকার জমিদারি ও রাজা
প্রথা বাতিল করে দিলে প্রজারা তাদের নিয়ন্ত্রিত
জমির মালিক হয়ে যায়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় কমিটি
বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা
বলেন, '৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পরই ভারতে
জমিদারি ও রাজা প্রথা বাতিল করে দেয় সরকার। সে
সময় কোচবিহারের মহারাজা ছিলেন শ্রীশ্রী
নারায়ণ ভুগ বাহাদুর। তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন
পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া তাঁর সব জমি ও
সেখানে অবস্থানরতদের ভারতের সঙ্গে
থাকতে। কিন্তু তাঁর প্রজারা অধিকাংশই মুসলমান হওয়ায়
তারা পূর্ব পাকিস্তানে থাকার ইচ্ছা পোষণ করে।
মহারাজা নিজে হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তিনি থেকে
যান ভারতে।
ছিটমহল নিয়ে কাজ করা সূত্রগুলোর তথ্য অনুসারে
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চার জেলার মধ্যে পড়ে
কোচবিহার মহারাজার ১১১টি ছিটমহল। এসব
ছিটমহলের মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় পড়েছে
৩৬টি (মূল ১২টি)। এ ছাড়া লালমনিরহাটে ৫৮টি,
কুড়িগ্রামে ১২টি এবং নীলফামারীতে চারটি
ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে।
এদিকে কালের কণ্ঠ'র পঞ্চগড় প্রতিনিধি সাইফুল
ইসলাম বাবু জানান, আজ বিকেলে ঢাকায় বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ছিটমহল
বিনিময়ের চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষায় মুখিয়ে
আছে সব ছিটমহলের মানুষ। উৎসব-আনন্দের
প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে জায়গায় জায়গায়।
ঘোষণার পরপরই ছিটমহলে কারো কারো
বাড়িতে ছাগল জবাই, কারো বাড়িতে মিলাদ মাহফিল,
আবার কেউ বা মিষ্টির আগাম অর্ডার দিয়ে
রেখেছে। অনেকে বাড়িতে গোশত-
পোলাওয়ের আয়োজন করেছে। দাওয়াত
দিয়েছে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের।
পঞ্চগড়ের গারাতি ছিটমহলের শালবাগান এলাকার চান মিয়া বলেন, 'হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের ডাবরভাঙ্গা গ্রামের শ্বশুরবাড়ি ও তাঁদের প্রতিবেশীরা বাংলাদেশি হওয়ায় আমাদের নানা কটাক্ষ করত। এ জন্য ২২ বছর ধরে শ্বশুরবাড়ি যাইনি। ভারতে বিল পাসের পর স্ত্রী হাজেরা ও ছোট সন্তানকে নিয়ে সেখানে যাওয়া শুরু করেছি।'
গারাতি নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান মফিজার রহমান ছিটমহলটিকে ইউনিয়ন ঘোষণার দাবি জানিয়ে বললেন, পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদের
আদলেই এখানে ভোট হয়। প্রতিনিধি নির্বাচিত বা
মনোনীত করা হয়। এ জন্য উন্নয়নের মূল
স্রোতে নিয়ে যেতে ছিটমহলটিকে ইউনিয়ন
ঘোষণার বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ
করেন। তিনি বলেন, 'ছিটমহল বিনিময়ের চূড়ান্ত
ঘোষণা ভালো-মন্দ যেভাবেই হোক না কেন
সেটা উদ্যাপনে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।'
নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ছিটমহলের অনেক ছেলেমেয়ে বাংলাদেশি ঠিকানা দিয়ে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে।
কিন্তু ছিটমহলের নাগরিক হওয়ায় তারা ভালো
কোনো চাকরি পায়নি।
চেয়ারম্যানের নিজের ছেলে সফিউল ইসলাম
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাস করেও চাকরি না
পেয়ে চাষাবাদ ও ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িত
হয়েছেন জানিয়ে বলেন, 'এখন মিথ্যা ও
লুকোচুরির দিন শেষ হয়ে এসেছে। এখন
আমাদের ছেলেমেয়েরা যোগ্যতা অনুযায়ী
কাজের সুযোগ পাবে।'
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি ময়নুল হক বলেন, 'কোন শর্তে ও প্যাকেজে ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে সেদিকে আমরা নজর রাখছি।
আমাদের দাবি, ছিটমহলের নাগরিকদের যেভাবে
সহজে নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় সেই পন্থা অবলম্বন করা হোক।'
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও
সমন্বয় কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, সরকারের আন্তরিকতা রয়েছে বলেই বাজেটে দুই শ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশ্যই ছিটমহলবাসীর জীবনমান
উন্নয়নে তাদের পরামর্শেই সরকার সার্বিক
পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
0 comments:
Post a Comment