Sunday, June 19, 2016

কর্মমুখর সিরাজগঞ্জের তাঁতীপল্লি

সিরাজগঞ্জ : দীর্ঘ মন্দার পর পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁত প্রধান এলাকাগুলো এখন কর্মমুখর হয়ে উঠেছে। দিনরাত তাঁতের খট খট শব্দ জানান দিচ্ছে এ শিল্প মন্দা কাটিয়ে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে।
মালিক ও শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। জেলায় তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত আধুনিক রুচিশীল কাপড়। জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, বেনারসি, শেড শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে তাঁতপল্লিগুলোতে।
শাড়ির ওপরে বর্ণিল সুতা, বাক ও চুমকির কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া কাপড়ের ওপর প্রিন্ট এবং রঙতুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। বিভিন্ন নকশার তৈরি কাপড়ের চাহিদা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে ভারত, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, বেলকুচি ও এনায়েতপুরের খুকনীর তৈরি বেনারসি শাড়ি ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁত কারখানার মালিকরা। কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে দিনরাত কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকরা। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, বেলকুচি, চৌহালী, উল্লাপাড়া পাবনার জেলার তাঁতপল্লি।
গত বছরের এ সময়ের চেয়ে বেশি দামে কাপড় কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
তাঁত প্রধান এলাকা শাহজাদপুরের খুকনী, এনায়েতপুর, বেতিল, ও বেলকুচি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কারখানা মালিক ও শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছে শাড়ি, লুঙ্গি তৈরিতে। বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড়দেয়া ও রঙতুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননের কাজেও সহযোগিতা করছে ওই এলাকার নারী শ্রমিকরা।
চলতি বছরের প্রথম থেকেই তাঁতিদের সফলতা আসতে শুরু করেছে। এ অঞ্চলের তাঁতপল্লিগুলোতে উন্নতমানের জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, সুতি জামদানি, বেনারসি ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিস ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব শাড়ি ও লুঙ্গি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। ঢাকার বুটিক হাউজ কে-ক্রাফট তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে কানাডা ও আমেরিকায় এবং নগরদোলা বুটিক হাউজ ইংল্যান্ডে বাজারজাত করছে। এছাড়া ঈদের বাজারে সোনার বাংলা টেক্সটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, স্ট্যান্ডার্ড, আমানত শাহ, রুহিতপুরী, স্মার্ট, অমর, পাকিজা, এটিএম, বোখারি, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, চাচকিয়া, ওয়েস্ট, রঙধনুসহ ১২৫টি ব্র্যান্ডের লুঙ্গি চাহিদা বেড়েছে।
সিরাজগঞ্জ চেক ইন্ডাস্টিজের ম্যানেজার আব্দুল মান্নান মোল্লা জানান, এক দশক ধরে সুতা, রঙ ও তাঁত উপকরণের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতীয় শাড়ির আগ্রাসনে তাঁত শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ওই সময় অনেক তাঁতিই পুঁজি সঙ্কটে পড়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। ফলে লাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। মৃত ও বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় এই তাঁত শিল্পকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে আন্তর্জাতিকমানের এবং সময়োপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় এ শিল্প প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। তাঁতীরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসেবে দেখছেন না। মান্ধাতা আমলের বুননশৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সঙ্গে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময়োপযোগী করে বুননশৈলী আর রঙের মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলে তাঁতের কাপড়।
শাহজাদপুরের পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ী আল হেলাল জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা শাহজাদপুর ও আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। তবে দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
শাহজাদপুরে হাটে আসা কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চলের তৈরি কাপড় কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গারামপুর ও পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রি হচ্ছে। ভারতের চেয়ে এ দেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকসই এবং উন্নতমানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন।
তিনি জানান, ভারতের রপ্তানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গির চাহিদা রয়েছে সব চেয়ে বেশি। তারা বাংলাদেশি লুঙ্গি মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি করছে।
বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলাসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রিত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না, থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফেব্রিক্স তৈরি করা হচ্ছে তাঁতপল্লীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতিরা উন্নতমানের জামদানি নকশা, শেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ আর ফতুয়া তৈরি হচ্ছে। জামদানি থ্রি-পিস দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রি-পিস ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঈদ সামনে রেখে স্বর্ণলতা নামে নতুন একটি শাড়ি বাজারে এনেছেন শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও বেলকুচির তাঁতিরা। হাফ সিল্কের ওপর ঝুটের মনমুগ্ধকর নকশা করা। কাপড় খুললেই স্বর্ণের মতো ঝলমল করে বলেই এর নাম রাখা হয়েছে স্বর্ণলতা। ইতোমধ্যেই এ শাড়ি ক্রেতাদের মন কেড়েছে। বাজারে এর দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
স্বর্ণলতা কাপড় প্রস্তুতকারক দরগাপাড়া গ্রামের তাঁতি আলহাজ আজমল কবীর বলেন, ‘রুচিশীল ক্রেতাদের বিষয়টি খেয়াল রেখেই ভারত থেকে জুট এনে তা দিয়ে হাতে বিভিন্ন নকশা করে স্বর্ণলতা শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। এ শাড়ির প্রকৃত নাম সাউথ কাতান। ইতোমধ্যে বাজারে এ শাড়ির চাহিদা আকাশছোঁয়া। তার কারখানায় উৎপাদিত কাপড় আগাম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’
পাইকারি বিক্রেতা গোপিনাথপুরের সেলিম রেজা ও গোপরেখীর এসএম সুজন মাহমুদ জানান, দীর্ঘ মন্দার পর ঈদ সামনে রেখে কাপড়ের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাঁতিদের পিছে পিছে ঘুরে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় মিলছে না। ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে তাঁতিদের বাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে যাচ্ছে। অনেক তাঁতিই তার কারখানার কাপড় আগাম বিক্রি করে দিয়েছেন। যদি কাপড় পাওয়া যায় তবে তার দাম অনেক বেশি।
গোপালপুরের তাঁতি শফিকুজ্জামান শফি বলেন, ‘বাজারে কাপড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সঙ্কটের কারণে তারা কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। দফায় দফায় সুতা, রং ও অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার কারণেই কাপড়ের দাম বেড়েছে।’
সুতা ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম শহিদ জানান, তুলার সঙ্কট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সুতার দাম বৃদ্ধির কারণেই স্থানীয় বাজারে সুতার দাম বেড়ে যায়। বর্তমানে তুলার সঙ্কট না থাকায় সুতার দাম কমতে শুরু করেছে।
তাঁত শ্রমিক আসাদুজ্জামান, সোহেল সেখ, আকরাম হোসেন, খলিলুর রহমান, আব্দুর রহিম জানান, পরিশ্রম অনুযায়ী মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছেন না। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সপ্তাহে ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। বাজারে কাপড়ের দাম বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। আগের তুলনায় কাপড় তৈরিতে সময় এবং পরিশ্রম বেশি হলেও মালিক নামমাত্র মজুরি বাড়িয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়তি রোজগারের আশায় তারা রাতদিন কাজ করছেন বলে জানান।

0 comments:

Post a Comment