রিমন রহমান:
গরুর মাংস উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে রাজশাহীতে। সাধারণ একটি গরু থেকে যেখানে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ কেজি মাংস পাওয়া যায়, সেখানে নতুন জাতের একটি গরু থেকে পাওয়া যাবে ৮০০ থেকে এক হাজার কেজি মাংস। এ জন্য গরুর শরীরে বাড়তি কোনো হরমন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়বে না। দরকার হবেনা গরুকে ষ্টেরয়েড গ্রুপের নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনেরও। গবাদি পশুর সাধারণ খাদ্য খেয়েই মোটাতাজা হবে গরু। নতুন জাতের এই গরু উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ইতিমধ্যে রাজশাহীর তিন উপজেলায় কাজ শুরুও করে দিয়েছে সরকারি এ দপ্তরটি।
জেলা অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন সিল্কসিটি নিউজকে জানিয়েছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাংসল জাতের গরু উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় জেলার পবা, পুঠিয়া ও চারঘাট উপজেলার ১৫০ জন খামারির বাড়িতে বেড়ে উঠছে আমেরিকার ব্রাহামা জাতের গরু। আমেরিকায় মূল জাতের এই গরুর এক একটির ওজন হয়ে থাকে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার কেজি পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশী গাভীকে এই জাতের গরুর সিমেন দেয়া হলে জন্ম নেয়া এঁড়ে বা বকনার ওজন পর্যাপ্ত বয়সে হবে ৮০০ থেকে এক হাজার কেজি। তাই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নির্বাচিত খামারিদের গাভীকে মাত্র ৩০ টাকার বিনিময়ে এই জাতের গরুর সিমেন দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি রাজশাহী আসে। সে সময় জেলার তিনটি উপজেলা নির্ধারণ করে প্রত্যেক উপজেলায় ৫০ জন করে খামারি নির্বাচন করতে বলা হয়। নির্দেশনা পেয়ে রাজশাহী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকল্পের জন্য জেলার পবা, পুঠিয়া ও চারঘাট উপজেলাকে নির্ধারণ করেন। সে সময় তারা প্রাথমিকভাবে প্রতিটি উপজেলা থেকে ১৩০ জন করে খামারির তালিকা করেন। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে প্রতি উপজেলায় ৫০ জন খামারিকে প্রকল্পের সুবিধা দেয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের প্রথম থেকে এই তিন উপজেলায় প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, গাভী প্রজনণের সময় হলে নির্বাচিত খামারিরা স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। তারপর স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অথবা তার মাঠকর্মীরা ওই গাভীকে আমেরিকার ব্রাহামা জাতের গরুর সিমেন দিয়ে আসেন। এ জন্য খামারিদের কাছ থেকে নেয়া হয় মাত্র ৩০ টাকা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দীন জানান, তিন উপজেলার ১৫০ জন খামারির প্রায় ৫০০ গাভীকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর এরই মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক বাছুর-বকনার জন্ম হয়েছে ব্রাহামা জাতের। এগুলোর বর্তমান বয়স ৫-৭ মাস। দেড় বছর বয়স হলে বাছুর গুলো যখন এক একটি এঁড়ে হয়ে উঠবে, তখন তার ওজন হবে ৮০০ থেকে এক হাজার কেজি। যার প্রতিটির বাজার মূল্য হবে সর্বনি¤œ আড়াই লাখ টাকা।
তিনি আরো জানান, খামারিদের এই প্রকল্পের আওতায় আনার আগে তাদের একটি শর্তও দেয়া হয়েছে। আর তা হলো, দেড় বছর বয়সের আগে গরু গুলো বিক্রি করতে পারবেন না তারা। তারপরেও অনিবার্য কারণে গরু বিক্রি করতে হলে অবহিত করতে হবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে। পরীক্ষামূলক এই প্রকল্পটির সফলতা বিবেচনা এবং একই সঙ্গে খামারিদের আর্থিকভাবে লাভবান করতেই এ ধরনের শর্ত দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জেলার পুঠিয়া উপজেলার পানপাড়া গ্রামের খামারি শাহাদত হোসেনের দুটি গাভী রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়। তিনি জানান, তার দেশী জাতের একটি গাভী থেকে জন্ম নেয়া আমেরিকার ব্রাহামা জাতের একটি বাছুরের বর্তমান বয়স পাঁচ মাস। অথচ এখনই বাছুরটির ওজন ৯৪ কেজি।
চারঘাট উপজেলার পরানপুর গ্রামের খামারি দিলিপ চন্দ্র সিল্কসিটি নিউজকে জানান, তারও তিনটি গাভী রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়। দুটি গাভী থেকে জন্ম নিয়েছে ব্রাহামা জাতের দুটি বাছুরও। দু’মাস আগে দু’মাস বয়সী একটি বাছুরের ওজন মেপেছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তখন বাছুরটির ওজন পাওয়া যায় ৬০ কেজি। আর ওই বাছুরটির জন্ম হয়েছিল ২৫ কেজি ওজনে।
পবা উপজেলার বসড়ি হরিপুর গ্রামের শাহীন আলীরও দুটি গাভী রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়। তিনি বলছিলেন, বাছুর জন্ম নেয়ার পর দেড় বছরের মধ্যে বিক্রি করা যাবেনা, এমন শর্তের কারণে প্রথমে তিনি প্রকল্পে অংশ নেয়া নিয়ে দোটানার মধ্যে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে খুব লাভবান হয়েছেন বলেই এখন মনে করেন। তিনি বলেন, গ্রামে এখন তার বাছুরের চেয়ে মোটাতাজা বাছুর আর কারো নেই। তার বাছুর দেখেই এখন অন্যান্য খামারিরা ঈর্ষান্বিত।
পবা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ইসমাইল হক জানান, খামারিদের লাভবান করতেই সরকার এই প্রকল্পটি চালু করেছে। তাই গাভী গুলো গর্ভবতী হওয়া থেকে শুরু করে বাছুরের বেড়ে ওঠা পর্যন্ত সব সময়ই খোঁজ খবর রাখা হয়। গাভী-বাছুর গুলো অসুস্থ হলে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে চিকিৎসাও দেয়া হয় বিনামূল্যে। কেননা, প্রকল্পের আওতায় থাকা গরু গুলোকে নিজেদেরই সম্পদ মনে করে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
পুঠিয়ার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতিকুর রহমান জানান, এ উপজেলায় প্রায় শতাধিক বাছুরের জন্ম হয়েছে ব্রাহামা জাতের। এসব বাছুর দেখে এখন বহু খামারি নতুন করে প্রকল্পের আওতায় আসতে চাইছেন। কেননা, দাম খুব বেশি হওয়ায় বাইরে পশু চিকিৎসকদের কাছে ব্রাহামা জাতের গরুর সিমেন কিনতে পাওয়া যায়না। শুধু খামারিদের লাভবান করার স্বার্থে সরকার এ খাতে ভূর্তুকি দিয়ে আমেরিকা থেকে সিমেন গুলো আমদানি করছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দীন সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ব্রাহামা জাতের গরুর ওজন খুব বেশি হওয়ায় এ জাতের গরু থেকে তেমন দুধ উৎপাদন হয়না। শুধু মাংসের জন্যই এ গরু বিখ্যাত। তাই বকনা না হয়ে বাছুর জন্ম নিলেই খামারিরা বেশি খুশি হন। তারপরেও বকনা জন্ম নিলেও ক্ষতি নেই। কারণ ব্রাহামা জাতের বকনা গুলো গাভী হয়ে ওঠার পর একই জাতের এঁড়ের সঙ্গে মিলন হলে জন্ম নেয়া গরুর ওজন হবে আরো বেশি। যদিও এখন দেশী জাতের গাভী থেকে জন্ম নেয়া এক একটির ওজন হবে ৮০০ থেকে এক হাজার কেজি।
ব্রাহামা জাতের গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তিনি বলেন, অত্যন্ত মোটাতাজা গরু দেখে যে কেউ মনে করতে পারেন এর মাংসে তেমন পুষ্টি নেই। কিন্তু বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এ জাতের গরুকে ষ্টেরয়েড জাতীয় নিষিদ্ধ ওষুধ খাইয়ে মোটাতাজা করার প্রয়োজন পড়েনা। গরীর শরীরে বাড়তি কোনো হরমন প্রয়োগেরও দরকার নেই। গবাদি পশুর সাধারণ খাবার খেয়েই গরু গুলো মোটাতাজা হয়ে ওঠে। তাই এর পুষ্টি গুণও অটুট থাকে।
রাজশাহীর তিন উপজেলায় এখন প্রায় পাঁচ শতাধিক গরু ব্রাহামা জাতের বাচ্চা প্রসব করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০টি বাছুর এবং বাকি গুলো বকনা। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এসব বাছুর ও বকনা গুলো বেড়ে ওঠার পর কয়েক বছর পর এমন পরিস্থিতি তৈরী হবে, যখন আর সিমেন আমদানি করে প্রজনণ উপযোগী গাভীকে দেয়ার প্রয়োজন হবেনা। প্রাকৃতিক নিয়মেই একই জাতের গরুর সঙ্গে সঙ্গম হয়ে জন্ম নেবে হাজার হাজার ব্রাহামা জাতের গরু। তখন বিপ্লব ঘটবে মাংস উৎপাদনে। আর ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন খামারিরা।
0 comments:
Post a Comment