বাপ-দাদার রাইহ্যা যাওয়া পরায় ৪০ বিঘা জমি’ সব যমুনা খাইয়া নিছে। এক চিলতা জমিও নাই। পরের জমি ভাড়া নিয়া তাতে ঘর তুইল্যা থাইকত্যাছি। তাও আবার যমুনার তীরেই। ওইটাও যহন-তহন যমুনার পেটে যাইবো। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের সিমলা গ্রামের এক সময়ের জোতদার কৃষক হাফিজ উদ্দিন মল্লিক। আঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাচ্ছিলেন নদী গর্ভস্থিত তার বাপ-দাদার সম্পত্তি। আর বলছিলেন সুখময় পুরনো দিনগুলোর কথা।
এক সময়ে নাম-ডাকওয়ালা জোতদার কৃষক পরিবারের ছেলে হাফিজ উদ্দিন মল্লিক। মাঠভরা ফসল, আর ঘরভরা সুখ ছিল তার। ২২ বছরের ব্যবধানে তার সব সম্পত্তি উদরস্থ করেছে যমুনা। এখন তিনি বাস্তুহারা-ভূমিহীন।
পাঁচঠাকুরী-বালিঘুগরী নতুন নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে বাৎসরিক ৭শ’ টাকা ডিসিমাল ভাড়া করা জমিতে দু’টি টিনের ঘর তুলে সন্তানাদি নিয়ে বাস করছেন সিমলা গ্রামের কৃষি দিনমজুর ষাটোর্ধ্ব বয়সী চাঁন মিয়া। শুকনো কন্ঠে দীর্ঘশ্বাস টেনে তিনি বললেন, আমার বাড়িও আছিল চরায় ৫/৬ বিঘা জমিও আছিল। ২২ বছরের মধ্যে ৭ বার বাড়ি ভাইঙছে, চরার জমিও নদীর মধ্যে পইড়ছে। হ্যাশে ওয়াপদার উপর আশ্রয় নিলাম, ওয়াপদাও ভাইঙ্গা গেল। এহন পরের জমি ভাড়া কইৠা ঘর তুইল্যা আছি। অন্যের ক্ষ্যাতে কৃষিকাম কইর্যা জীবন চালাই।
একই গ্রামের শাহ আলী জানালেন, তার ১৫ বিঘা জমি ছিল। এহন এক ডিসিমালও নাই। অন্যের জমিতে মজুর খেটে ৯ জনের সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
একই অবস্থা এককালের কৃষক বর্তমানে রিকশাচালক নজরুল ইসলামের। তাঁত শ্রমিক রফিকুল ইসলাম, কৃষি দিনমজুর মনোয়ারুল ইসলাম, আবুল তালুকদার, শাহজাহান আলী, মোনাফ, আব্দুল হামিদ, শাহ আলী, বাচ্চু শেখসহ প্রায় সাড়ে ৭শ’ পরিবারের।
এদের প্রত্যেকেরই পাঁচ থেকে অর্ধশত বিঘা পর্যন্ত জমিজমা ছিল। এখন জমি তো দূরের কথা মাথা গোঁজা ঠাঁই পর্যন্তও নাই। নদীভাঙা ভূমিহীন এ সব মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা তাদের হারানো সুখের দিনগুলোর পাশাপাশি বর্তমান দুঃসময়ের বিবরণ দিয়ে চলেন।
যমুনার তীরবর্তী উর্বর জমির বুক উজাড় করা ফসলের হাসির পাশাপাশি ছিল নদীর বুকে রুপালী মাছের ঝলকানি। এখানকার কৃষকদের খুশি ছিল নিত্যদিন। দিনভর মাঠের কাজ শেষে বিকেলে নদী থেকে মাছ ধরে ঘরে ফেরা কৃষকের হেরে গলায়
গাওয়া জারি গান কৃষাণির মনে এনে দিত আনন্দের ঢেউ।
ওইসব সোনালী দিনগুলি এখানকার কৃষকের কাছে শুধুই স্মৃতি। আশ্রয়হীন এসব মানুষ এখন অপরের জমির দিনমজুর। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর ২৫০/৩০০ টাকা মজুরি নিয়ে ঘরে ফেরার পর নানা অভাব-অনটনের কথা শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়া। আবার সকালে কাজের সন্ধানে বের হওয়া।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ৪২ বছর ধরে ভাঙনের মুখে থাকা সিমলা গ্রামটি চলতি বছরে সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়। আর এ গ্রামের সাড়ে ৭শ’ কৃষক পরিবার ভূমিহীন হয়ে পড়েন। এরা কেউ কেউ অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে তাতে ছোট ছোট ঘর তুলে বাস করছেন। কেউ কেউ ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে দূরে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে বসবাস করছেন।
এছাড়াও গ্রামের ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে চলেও যাওয়ায় কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বার বার বিদ্যালয়ের স্থান পরিবর্তন ও পরিবারের লোকজনের আবাস স্থানান্তরের কারণে শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতা ও গাফলিতর কারণে বার বার ভাঙনের কবলে পড়ে এই গ্রামটি। দফায় দফায় ভাঙনে পুরো গ্রামটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে গ্রামটি নামে থাকলেও এটির কোনো ভূখণ্ড নেই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য তারিকুল ইসলাম জানান, আমরা সিমলা গ্রামের নাগরিক হলেও বর্তমানে আমাদের বসবাস পাঁচ ঠাকুরী গ্রামে। অনেকেই সিমলা গ্রামের পরিচয় দিয়ে বাস করছেন, মটিয়ারপুর, ডিগ্রিপাড়া, বাহুকা, ভেওয়ামারাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে।
তিনি আরও জানান, এ বছর সারা জেলায় তেমন নদী ভাঙন ছিল না। শুধু সিমলা গ্রামের পাশে বালিঘুগরী-পাঁচঠাকুরী পাউবোর বাঁধটি ভাঙনের কবলে পড়ে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এই একটি বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ছোনগাছা ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন কিরণ বাংলানিউজকে জানান, এ গ্রামে প্রায় সহস্রাধিক পরিবার বাস করতো। ভোটার ছিল ১৭শ’। অনেক আগে থেকেই গ্রামটি ভাঙনের মুখে পড়ে। তবে এ বছরেই গ্রামটি সম্পূর্ণরুপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভূমিহীন হয়ে পড়ে গ্রামের সাড়ে ৭শ’ পরিবার।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ঈমাম বাংলানিউজকে জানান, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যমুনা নদী প্রায় দুই কিলোমিটার ডান দিকে ঘুরে গেছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রাম বিলিন হয়ে গেছে। সিমলা গ্রামটিও এই ভাঙনের মধ্যে পড়ে।
0 comments:
Post a Comment