সুজিত সরকারঃ
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় ১০ টাকা দরের চাল বিক্রিতে নানা অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সব দূর্ণীতির মধ্যে রয়েছে, গরিবের চাল কালোবাজারে বিক্রি, ডিলার নিয়োগে অনিয়ম দূর্ণীতি, কার্ড বিতরণ না করা,তালিকা ভূক্তদের চাল না দেওয়া, অবস্থা সম্পন্ন বিত্তবানদের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা, হতদরিদ্রদের তালিকায় বাদপড়ার অভিযোগ রয়েছে। এ উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নের ২৬ জন ডিলারের মধ্যে ২৩ জন ডিলারই আওয়ামীলীগ,যুবলীগ,সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা-কর্মী। বাকি ২ জন বিএনপি নেতা। একজন সাবেক ছাত্রদল নেতা। ডিলারশীপ পেয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাই, ভাইস চেয়ারম্যানের শ্যালোক, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, তাদের ভাই আত্বীয়-স্বজন ও চাকরি জীবি। এ সব ডিলারের মধ্যে আবার যারা সরাসরি মাঠের রাজনীতি করেন না তাদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগকারিরা জানিয়েছেন। এ সব ডিলারের অধিকাংশরই নিজস্ব কোন দোকান ঘর নেই। চাল বিতরণকালে কাপড়ের ব্যানার টানিয়ে পরিচিত ব্যক্তির দোকানের সামনে ২/৩ ঘন্টায় চাল বিতরণ শেষ করে থাকেন। প্রায় সব ইউনিয়নেই সুবিধা ভোগীদের অর্ধেকের বেশি ব্যক্তিদের মাঝে কার্ড বিতরণ করা হয়নি। এ সব কার্ডের অধিকাংশই আবার সচ্ছল ওবিত্তবান ব্যক্তি হওয়ায় তারাও এর জন্য তেমন কোন উচ্চ বাচ্য করছেন না। এ সুযোগে এ সব কার্ডধারিদের বরাদ্দের চাল কালো বাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগকারিরা জানিয়েছেন। অভিযোগকারিদের মধ্যে বেলতৈল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস হোসেন ফুল জানান, তার ইউনিয়নের এক ডিলার এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ সুবিধাভোি দের মাঝে কার্ড বিতরণ করেননি। স্বচ্ছল ব্যক্তিদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সোনাতুনি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ফজলু, তার ছেলে রুবেল রানা, ভাই সামছুল ইসলাম জানান, এ তালিকায় কাদের নাম অন্তভূক্ত করা হয়েছে, কবে কোথায় কি ভাবে, কাদেরকে চাল দেওয়া হচ্ছে দুই ডিলারের কেউই তাদের জানায়নি।সোনাতুনি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতিও ছোট চানতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম মর্তুজার ভাই ও সাধারণ সম্পাদক আয়েজ উদ্দিনের ভাইয়ের নামে ডিলারশিপ নিয়ে মূলত তারাই এর সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। অনিয়ম-দূর্ণীতির কথা স্বীকার করে বলেন, প্রতি ডিলারের ৫‘শ জন করে মোট ১ হাজার জনকে এই চাল দেয়ার কথা তাকলেও অর্ধেকও দেয়া হচ্ছেনা বলে তারা অভিযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তারা বিএনপি করেন বলে এর প্রতিবাদ করতে সাহস পাননা। সোনাতুনি ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার সামছুল ইসলাম ও কুরসিগ্রামের নূরুল ইসলাম,ইয়াসিন মোল্লা, খালেক মোল্লা শান্তাই খাঁ জানান, তাদের পাড়ার কাউকেই এই চালের কার্ড দেয়া হয়নি। ছোটচানতারা গ্রামের সানোয়ার হোসেন ও ডাঃ আবু দাউদ জানান, তাদের গ্রামের স্বচ্ছল সাত্তার আলী ও আজিজুল হক ১০ টাকার চালের কার্ড পেয়েছেন। কিন্তুঅধিকাংশ হতদরিদ্ররা এ কার্ড পাননি।পোরজনা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার মজিবর রহমান ও ১নং মহিলা ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার আছমিনা খাতুন জানান,৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের মধ্যে শুধু বাচড়া গ্রামের ১৮ জনকে এ কার্ড দিয়েছেন। বাকি গ্রাম গুলোতে এ কার্ড দেয়া হয়নি। বেলতৈল ইউনিয়নের চরকাদই গ্রামের হতদরিদ্র তাঁত শ্রমিক সেলিম হোসেন জানান, তার নামে কার্ড হয়েছে, সে প্রথম দফায় একবার চালও পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় চাল তুলতে গেলে তাকে চাল না দিয়ে ফেরত দেয়া হয়। বলা হয় তার নাকি কার্ড বাতিল হয়ে গেছে। তাই আর তোমাকে চাল দেয়া যাবেনা। ফলে সে শুন্য হাতে ফিরে এসেছে। এ গ্রামের শুকুর মাহমুদ, সুলতান, রিপন বলেন, আমরা খুব অভাবি মানুষ। হাতে কাম কাজ করতে নাই। আমরাএকটাও কার্ড পাইনি। অথচ এ গ্রামের সচ্ছল ও বিত্তবান আব্দুল মান্নান সরকার পেয়েছেন কার্ড। তার ৩ ছেলের এক জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার,একজন পুলিশ বিভাগে ও আরেক জন গার্মেন্টেসে ১৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। ৪/৫ বিঘা জমি, বাড়ির বিশাল আঙ্গীনায় ৩টিচকচকে বড় বড় টিনের ঘর রয়েছে তার। তার পরেও তিনি এ কার্ড পেয়েছেন। আব্দুল মান্নানের স্ত্রী আছিয়া খাতুন ও পুলিশ বিভাগে চাকরিরত ছেলে আফসার এর সত্যতাও স্বীকার করেছেন। বেলতৈল ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি সরোয়ার হোসেন বলেন, তার ইউনিয়নে কমপক্ষে দেড়‘শ বিত্তবান লোকের নাম তালিকায় আছে। আমি এ তালিকা দেখতে চাওয়ায় ডিলার ও তার লোকজন তালিকা দেখতে না দিয়ে আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। আমি শাহজাদপুর উপজেলা ফুড অফিসারের কাছে গেলে তিনিও এ তালিকা দেখাননি। বলেছেন আমি বলে দিচ্ছি ডিলারই আপনাকে দেখাবে। আমি আবারও ডিলারের কাছে গেলে সে আমার সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করে। এ ব্যাপারে ডিলার মামুনুর রশিদ হিলটন বলেন, ভুল বসত ২/১ জনের নাম থাকতে পারে যাচাই বাছাই করে এ ধরণের নাম বাদ দেয়া হবে। সভাপতি সরোয়ারের সাথে খারাপ আচরণের ব্যাপারে বলেন, একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। পরে তা ঠিক হয়ে গেছে। গালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল বাতেন জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নে ১০ টাকা দরের চাল বিতরণ ও তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ তিনি পেয়ে প্রশাসনকে জানিয়েছেন। কিন্তু এখনো এর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, এ ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সভাপতি আব্দুল খালেক মোল্লা ও তার মনোনিত ব্যক্তি ডিলারি পেয়ে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ইচ্ছা মত কাজ করছেন। এ ব্যাপারে আব্দুল খালেক বলেন, তিনি নিয়ম মেনেই কাজ করছেন। এ ছাড়া গাড়াদহ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন নয়ন, এ ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সভাপতি সেলিম আক্তারের ভাই আওরঙ্গজেব, হাবিবুল্লাহনগর ইউনিয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ রহমানের ভাই গোলাম সরোয়ার, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন,জালালপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের ক্রিড়া সম্পাদক ঠান্ডু, ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল হোসেন,খুকনি ইউনিয়নে যুবলীগ নেতা এনামূল হক রওশন,বেলতৈল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফেরদৌস হেসেন ফুলের ভাই কামাল হোসেন, কায়েমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসানের চাচাতো ভাই আল আমিন হোসেন, তার অনুগত আবু সাঈদ,পোতাজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর ভাতিজা আব্দুল আলীম, চেয়ারম্যানের বিস্বস্ত কোরবান আলী,রূপবাটি ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর বারী সরকার, বিএনপি নেতা আলম মোল্লা, পোরজনা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সদস্যআমজাদ হোসেন,আমিনুল ইসলাম,সোনাতুনি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি গোলাম মর্তুজার ভাই আব্দুল জলিল, সাধারণ সম্পাদক আয়েজ উদ্দিনের ভাই মজিবর রহমান, কৈজুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের এসিস্ট্যান্ড আবুলকালাম, বিস্বস্ত আওয়ামীলীগ নেতা পেশকার আলী ১০ টাকার চালের ডিলারি পেয়েছেন। এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা নজমূল করিম বলেন, সিরাজগঞ্জ-৬(শাহজাদপুর) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনের সুপারিশে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ যে তালিকা প্রস্তুত করে তাকে দিয়েছেন, তিনি সেটাই অনুমোদন করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহমেদ বলেন, তালিকা প্রস্তুত করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ট্যাগ অফিসারগণ। তিনি আরো বলেন, ১০ টাকার চালের ডিলারা কোন অনিয়ম দূর্ণীতি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে এমপি হাসিবুর রহমান স্বপনের মোবাইল ফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।