এলিস বচ্চনের রিপোর্টঃ চতুর্থদিনেও এমন দৃশ্য দেখা গেল শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়ামে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ ডাবল সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুলকে দেখার জন্য সবশ্রেণীর দর্শক উপস্থিত হয়। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, পুলিশবাহিনীর এসআই মামুনের চৌকস নেতৃত্বে মাঠে সব দর্শককে মাঠে ঢুকতে দেননি। প্রথম দফায় সফল হলেও খেলার শেষদিকে স্টেডিয়ামের আশেপাশের কিছুসংখ্যক লোক নিজেদের এলাকা মনে করে প্রবেশ করলেও এসআই মামুন একটাও ছাড় দেননি। মাঠের বাইরে বা গ্যালারী উঠে যাওয়ার জন্য আদেশ দেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় সেই আদেশ উপেক্ষা করে মাঠে একেবারে জনস্রোতে পরিণত হয়। সেকি দৃশ্য। একই সাথে মাঠে ডিজে পার্টি সারাক্ষণ প্রাণবন্ত পরিবেশ উজ্জীবিত পরিণত করতে সক্ষম হয়। তবুও এসপিএলের টানে স্থানীয় সোজা গ্যালারীতে উঠে যান। তবুও তো টুয়েন্টি টুয়েন্টির এই অভূতপূর্ব খেলা দেখতে অনেক দর্শকরা হাজির ছিলেন একমাত্র আশরাফুলের আর সিরাজগঞ্জ ক্রিকেটার্স এ্যাসিয়েশনের জন্য। সিরাজগঞ্জ ক্রিকেটার্স এ্যাসোসিয়েশনের অনুমতিসাপেক্ষে এক্রিটেশন কার্ড বা অফিসিয়াল কার্ড ছাড়া কেউ মাঠে প্রবেশাধিকারের কোনো সুযোগ নেই। এটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথামাফিক নিয়ম। সেই প্রথার নিয়ম দর্শকরা মানতে নারাজ। তাদের দাবি স্টেডিয়ামটা আমাদের। আমরা স্টেডিয়াম এলাকার লোক। তাই সবার আগে মাঠে ঢোকার অধিকার পাই। কিন্তু কথা হলো, জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব মাঠ হলো সরকারি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের। সেহেতু, পুলিশবাহিনীদের দখলে থাকে। ‘ঘরের লোকদের এখানে সেই প্রবেশাধিকার নাইÑবললেন এসআই মামুন। স্থানীয় লোকদের দাবি, ‘না এটা আমাদের মাঠ।’ এভাবে হলে তো এখানে আন্তর্জাতিক খেলার ভেন্যু কোনোদিনই স্বীকৃতি পাবে না। তার কারণ, স্থানীয় দর্শকদের এমন নেতিবাচক। মাঠে জায়গা নিয়ে বাদানুবাদ হয়। এটা ঘটছে তাদের নেতাগিরির ভাব দেখানো নিয়ে।
যাহোক, গতকাল মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ গ্ল্যাডিয়েটর্স সম্মাণজনক স্কোর গড়তে আবারো ব্যর্থ হলো। এর আগে সিরাজগঞ্জ নাইট রাইটার্স সর্বনিম্ন রান ১১০। গতকাল গ্ল্যাডিয়েটস করলো ১০৬ রান। এটাই টি২০’র সর্বনিম্ন স্কোর। ক্রিকেটের মান অনুযায়ী স্থানীয় খেলোয়াড়দের পারফরমেন্স উল্লেখযোগ্য নয়। প্রত্যাশা করার মতো এটা একেবারে বাজে। সোজা কথা, দর্শকরা গতকালকে খেলা দেখে তৃপ্তি খুঁজে পাননি। না ছিল সাসপেনসন। আর না ছিল নাটকীয়তা। নইলে এই নতুন ফর্মেটের পদ্ধতি অনেক খেলোয়াড়ের কাছে অজানা। একমাত্র একমাত্র আশরাফুলই ভালো জবাব দিয়ে গেছে। তার অভিজ্ঞতা অনেকের চেয়ে একদম আলাদা। মাঠের কন্ডিশন আর যাই হোক, ক্ষুদে সাকিব কিশোর বালক বয়সে এই টুয়েন্টিতে খেলার কথা না। কিন্তু হয়ে গেছে। তার কারণ, সাকিব তার স্বভাবগত অনুযায়ী ক্রিকেটের মেজাজটা বুঝে গেছেন। কিন্তু তার মতো অনেক কিশোর বালক সারা সিরাজগঞ্জে রয়েছে। কিন্তু ক’জন সুযোগ পায়? লটারির নাম উঠে সাকিবের নাম। আর বাকিরা আলোচনার বাইরে।
গতকালই দেখা গেলো দুপুরে। মুদ্রা নিক্ষেপের সময় টুর্নামেন্টের সদস্যসচিব মারুফ সিরাজী মাইক্রোফোন নিয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। দু’দলের ক্যাপ্টেন ডাকলেন। টস হলো। জয়ী হলো গ্ল্যাডিয়েটর্স। ক্যাপ্টেন সুনামের সঙ্গে মাইক্রোফোন করেন মারুফ সিরাজী। কিছু চুটকি কথাও বলেন। এরপরে টাইগার্সের মিলনও কথা বললেন। বেশ ইতিবাচক কথা সেরে নিলেন। আর কিছুক্ষণ পরেই টুর্নামেন্টের যুগ্মআহ্বায়ক জিয়াবাবু পিচের উপর রিপোর্টি করলেন। হাফ ইংরেজিতে হাফ বাংলায়। বেশ ভালো মনে হয়েছে। উপস্থাপনায় এরা যে পারেন সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। এই প্রথম তারা এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিরাজগঞ্জের ক্রিকেটকে অনেক দূরে টেনে গেলেন তারা দুইজন। মারুফ ও জিয়াবাবুই প্রথম দৃষ্টান্ত দেখালেন। স্থানীয় দর্শকরা চেয়ে চেয়ে দেখলেন তাদের দুইজনের উপস্থাপনায় উপমার কথা শুনে। মারুফ ও জিয়াবাবুকে উইশ করলেন আয়োজকরা।
যথারীতি মাঠে নামেন দুই আম্পায়ার আশফাক উল আজিজ সুমন ও মুরাদুজ্জামান মুরাদ। টিয়া রঙের পোশাক। কালো প্যান্ট। সাদা বল। খেলোয়াড়দের রঙিন জামা। যেনো ভিন্ন পরিবেশ। আর সঙ্গে টিপটপ বাহারী রকমের দুটি কালো সাইটস্ক্রিণ। মাঠের দক্ষিণে ও উত্তরে দুটি বিগ ব্যাঙের ছাতা। মাঠের পশ্চিমে ডিজে পার্টির প্রচারণা। পরিচালনা করেন ডিজে এলিন। ছক্কা ও বাউন্ডারি হলেই বেজে ওঠে এ্যাট্রাকশন থিম ট্র্যাক। আর মাঠে অবস্থানরত সিরাজগঞ্জ ক্রিকেটার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের সবুজ জামা পড়া আর গলায় ঝুলিয়ে রাখা অফিসিয়াল কার্ড। মাঠের পূর্বদিকে অস্থায়ী তাবুতে অফিসিয়ার স্কোর বোর্ড ও স্কোরার থাকছেন। দলীয় রানের হিসাব আর ক্যালকুলেটর রেকর্ড রাখছেন দুইজন। সাইদুল বারী রূপো ও স্কোর কার্ডে আশিক নাঈম। পাশাপাশি ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের জন্য ভিআইপি অস্থায়ী তাঁবু প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এখানে শুধুমাত্র দলের খেলোয়াড়, কর্মকর্তা ও শুভাকাক্সক্ষীরা বসার অধিকার পাচ্ছেন। মাঠের দক্ষিণে ও উত্তরে এই দৃশ্যমান চোখে পড়বে।
আর মেইনগেইট লাগোয়া অস্থায়ী পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সিরাজগঞ্জ ক্রিকেটার্স এ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের বিশেষ সৌজন্যে।
দুপুর ১টা। গ্ল্যাডিয়েটর্সের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ফিরোজÑপিয়াস জুটি নামেন। সেই শুরু। তারপর সবশেষে স্কোরবোর্ডে দেখা গেলÑএকদম নড়েবড়ে অবস্থা! রান অল্প। এই রান দেখে অনেকের ভালো লাগবে না। এমনকি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকও পর্যন্ত খুশি ননÑদলের এই রান দেখে! ‘৬ উইকেট, ১০৬ রান’। ১২০টি বল খেলে এই দশা করলো গ্ল্যাডিয়েটর্স। গ্ল্যাডিয়েটর্সের প্রতিটি পার্টনার ব্যাটসম্যানেরা প্রতিপক্ষ টাইগার্সের বোলারের তোপের কাছে কুপোকাত হয়ে গেছেন। ফলে বেশি রান ওঠেনি। পাশাপাশি টাইগার্সের ফিল্ডারদের অসামান্য দক্ষতায় গ্ল্যাডিয়েটর্সের রান আটকে দেন। সেটা সম্ভব হয়েছেÑঐ ৯৮ নাম্বার পিরহান পরিহিত আশরাফুলের একক বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ের ফল।
দিনের উল্লেখযোগ্য দিকটি ছিল অনেকদিন পর একটি স্বাস্থ্যসম্মত ইনিংসের খেলা উপহার দেন টাইগার্সের দলপতি ওপেনার মিলনের হাফসেঞ্চুরী। যিনি শুরু থেকেই উইকেটের চারপাশে পিটিয়ে খেলেন। এমন মহাকাব্যিক ইনিংসের খেলা মিলন যেনো একাই টেনে নিয়ে যান নিশ্চিন্তে..। ৫২টি বল মোকাবেলা করে ৫৯ রান। যথেষ্ট! তিনি উইকেটে যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত ৫টি বাউন্ডারী ও ৩টি ওভার বাউন্ডারী পিটিয়েছেন বোলারদের বল উড়িয়ে দিয়ে। ৩ ওভার অর্থাৎ ১৮ বল অব্যবহৃত ওভার রেখেই নির্ধারিত রানের দরজায় প্রবেশ করলো সিরাজগঞ্জ টাইগার্স। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয় ম্যাচ জিতলো টাইগার্স বাহিনীরা। ২ খেলায় ৬ পয়েন্ট নিয়ে যুগ্মভাবে শীর্ষে আছে টাইগার্স ও সুপার কিংস্। কিন্তু বড়ই হতাশের খবর হলো, আশরাফুল বেশি রান করতে পারেননি। ২৯ মিনিট ক্রিজে ছিলেন। ব্যক্তিগত ১০ রানে এলবিডাবলিউ হয়ে যান গ্ল্যাডিয়েটর্সের ৪ নম্বর বোলার শ্যানের বলে। যেই আশরাফুল আউট হলেন, অমনি উপস্থিত ভিড় জমে যাওয়া দর্শক ফাঁকা হতে শুরু করে। মানে দর্শকরা বাড়ির পথ ধরেন। তারা এসেছিলেন আশরাফুলকে ব্যাটিংয়ের নজরকাড়া খেলা দেখতে। কিন্তু আশরাফুল ভক্তরা হতাশ হয়ে মাঠ ছেড়ে যান।
সংক্ষিপ্ত স্কোর কার্ড :
সিরাজগঞ্জ গ্ল্যাডিয়েটর্স : ১০৬/৬, ২০ ওভার (ফিরোজ ১২, পিয়াস ২০, শ্যান ৩৮, সুনাম ৪, হাসান ১৯, শুভ ৫, আকাশ অপরাজিত ৫ ও রাব্বি অপরাজিত ০। ইমরান ৩/২৩, সাকিব ১৪/২, আশরাফুল ০/১৯, মিলন ০/২৩, মিম ০/২৭)
সিরাজগঞ্জ টাইগার্স : ১০৭/২, ১৭ ওভার (মিলন অপরাজিত ৫৯(৫২টি বল), মেহেদী অপরাজিত ১৯ (৪টি বাউন্ডারী), আশরাফুল ১০ (১৬টি বল, ১টি ছক্কা), মিলন ৭। শাহেনশাহ শুভ ১/১৫, শ্যান ১/২৫, ফিরোজ ০/১০, রাব্বি ০/১৬, রাজ্জাক ০/১৯, হাসান ০/২২)
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : দলপতি মিলন। ৫৯ রান ও ২৩ রানে ০ উইকেট।
গ্ল্যাডিয়েটর্স : সুনাম (অধিনায়ক ও উইকেটকিপার), হানি, শ্যান, হাসান, শাহেনশাহ শুভ, রাজ্জাক, আকাশ, পিয়াস, রাব্বি, আলহাজ্ব ও ফিরোজ। দ্বাদশ খেলোয়াড় মেহেদী।
টাইগার্স : মিলন (অধিনায়ক), মিলন (উইকেটকিপার), আশরাফুল, মিম, আলামিন, সাকিব, মেহেদী, সোহান, রাফুল, ইমরান ও রকি। দ্বাদশ খেলোয়াড় তৌহিদ।
আম্পায়ার : আশফাক উল আজিজ সুমন ও মুরাদুজ্জামান মুরাদ। স্কোরার : সাইদুল বারী রূপো। স্কোরবার্ড : নাঈম।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় খেলবে সিরাজগঞ্জ সুপার কিংস্ বনাম সিরাজগঞ্জ নাইট রাইডার্স।