Monday, September 28, 2015

আমার সন্তানরা ও সন্তানতুল্য যারা তাদের উদ্দেশ্য ‘দুটি কথা’ আনোয়ার হোসেন রতু

আজ কবিগুরুর রচিত ‘প্রার্থনা’ কবিতার অংশ বিশেষ দিয়ে আমার দুটি কথা শুরু করছি।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এনহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়
দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই বা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়’।
জীবনের চলার পথে দুঃখ কষ্টকে জয় করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। মনে রেখো,সেই চলার পথ অনেক সময় দূর্গম থেকে দূর্গমতম হতে থাকবে। কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। তুলে ধরবার জন্য আপন জন পাশে কেউ থাকবে না। তোমাকে একাই উঠে দাঁড়াতে হবে। আত্মপ্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে সমস্ত বাধা বিঘকে জয় করে জীবন পথের দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার একাই পাড়ি দিতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষই আজ মানবিক গুণাবলী হারিয়ে ফেলেছে। নইলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনাকীর্ণ লোকালয়ে সিলেটে শিশু রাজেনকে দীর্ঘক্ষণ ধরে অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে কতিপয় পাষন্ড হত্যা করে ফেললো। আর চারদিকে অনেকগুলো ভীরু কাপুরুষ হৃদয়হীন মানুষ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে সেই বিভীষিকাময় হত্যাকান্ডের দৃশ্যটি উপভোগ করলো। মৃত্যুর পূর্বে শিশুটি একটু পানির জন্য আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী করে তুলেছিল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কোন আদম সন্তানই মৃত্যুপথযাত্রী শিশুটির মুখে এক ফোটা পানি তুলে দিতে এগিয়ে গেল না। এ কোন বর্বর দেশে, আদিম যুগে বাস করছি আমরা? আইন কি বলে আমি জানি না। কিন্তু আমার বিবেক বলে, ‘যারা পাশবিক নির্যাতনের মাধ্যমে শিশু রাজনকে হত্যা করলো আর যারা চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করলো, উভয় দলই ঐ মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের জন্য সমপরিমাণ দোষী। কি বিচিত্র এই দেশ আর দেশের মানুষ! এখানে এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মার্তৃগর্ভের শিশুও নিরাপদ না। কিছুদিন পূর্বে মাগুরায় একই দলের দুই গ্র“পের অস্ত্রধারীর গুলিবিনিময়ের এক পর্যায়ে একজন অন্তঃসত্ত্বা মা ও তার গর্ভের সন্তান গুলিবিদ্ধ হলো। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করে গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় প্রসব করানো হলো। হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা শিশুটির নাম রেখে দিল সুরাইয়া। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারদের সুচিকিৎসা ও নার্সদের আন্তরিক সেবায় আরোগ্য লাভ করে গত ২০শে আগস্ট মা ও শিশু দু’জনেই সুস্থ হয়ে তাদের আত্মীয় পরিজনদের সাথে মাগুরা ফিরে গেছে। সম্প্রতি খুলনায় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি কাজ ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে শিশু রাকিবুলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। গাইবান্ধায় একজন দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে চার জন দুস্কৃতিকারী সারারাত পালাক্রমে ধর্ষণ করে মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। মাদারীপুরে তিন বছরের একটি শিশু ধর্ষিতা হয়ে আজও হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। ইভটিজিংয়ের দৌরাত্ম্যে দেশের সর্বত্রই মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ এর যুগের থেকেও অন্ধকারের রাজ্যে বাস করছি আমরা।
সভ্যতা ও বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগ আমাদের জীবনে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে বিবেক। বিবেকহীন মানুষ পশুর চেয়েও অধম,
হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের চেয়েও অনেক অনেক বেশী বিপদজনক।
তাইতো বিশ্বকবি অত্যন্ত বেদনা বিধূর হৃদয়ে লিখে গেছেন
‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেল সবে, বলে গেল ভালবাসো
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির দ্বারে,
আজি দুর্দ্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিচ্ছায়েÑহেনেছে নিংঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে,
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’
মিতা, অপু, রীতা, অনিতা, ইভা, দীপা ঃ
আগে অনেক বেশী যৌথ পরিবার ছিল। সেখানে ঝগড়াঝাটি ছিল, মনোমালিন্য ছিল, কিন্তু পরিবারের কেউ একজন বিপদে পড়লে সবাই সবকিছু ভুলে একযোগে তার পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তো। বর্তমান যুগে যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে। নাগরিক জীবনে সবাই ভিন্ন ভিন্ন পরিবার নিয়ে আলাদাভাবে বাস করে। সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্য প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেছে। গ্রামাঞ্চলের পারিবারিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি পরিবেশও তথৈবচ। তাই তোমাদের এখন নিজেদেরই ছেলে মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। ওরা যেন কখনও ভুল পথে বাড়াতে না পারে সেদিকে প্রতিনিয়ত বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। যা হোক, এবারে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনার কথা বলেই আমার ‘দুটি কথার’ দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ করবো। ১৯৮২/৮৩ সনে সিরাজগঞ্জের একটি রাস্তা মেরামতের রানিং বিলের বিপরীতে পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে একটা পঁচাশি হাজার টাকার চেক নিয়ে বিকাল তিনটায় পাবনা থেকে সিরাজগঞ্জের বাসে বাড়ী ফিরছিলাম। আমাদের বাসটি পাঁচটার দিকে তালগাছি হাট পার হওয়ার সময় একটি পাবনাগামী বাস বেশ দ্রুতগতিতে ডানপাশ অতিক্রম করে গেল। মুহুর্তকাল পরেই আমাদের বাসের পেছন দিক থেকে একজন মানুষের ভয়াবহ আর্তচিৎকার শুনে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি পেছনের যাত্রীরা সবাই সিট থেকে উঠে হুড়োহুড়ি করে সামনের দিকে চলে আসছে। কি ঘটেছে দেখার জন্য আমি ভিড় ঠেলে বাসের পেছনের দিকে গিয়ে দেখি,৪০/৪৫ বছর বয়সী একজন মানুষ সিটের সামনে পড়ে জবাই করা মুরগীর মত দাপাদাপি করছে আর ‘বাবাগো মাগো’ বলে চিৎকার করে চলেছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি লোকটার ডান হাতটা কনুইয়ের কাছ থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে হাতের কব্জির কাছে একটুখানি চামড়ার সাথে ঝুলছে। কেমন করে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল জানতে চাইলে চলন্ত বাসের মধ্যে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল,আহত লোকটি তার ডান হাতটা জানালা দিয়ে বাইরে ঝুলিয়ে রেখেছিল, আমাদের পাশ দিয়ে এইমাত্র যে বাসটি চলে গেল সেই বাসের সাথে চাপা লেগে এমনটি ঘটেছে। আহত লোকটির ভাঙা হাত থেকে ঝরণার মতো রক্ত ঝরছে। মুহুর্তের জন্য আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পেয়ে আমার কাছেই রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন যুবককে কাছে ডেকে তাদের আমাকে সাহায্য করতে বললাম। সাথে সাথেই ছেলে দু’টো এগিয়ে এলো। ইতিমধ্যে বাসের হেলপারটাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। আমি গুরুতর আহত লোকটির মাথার দিকটা ধরে বাকী তিনজনকে বুক থেকে পা পর্যন্ত চেপে ধরে লোকটাকে সিটের উপর তুলে শোয়ালাম। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। কারণ আহত লোকটি দারুণভাবে দাপাদাপি করছিল। আহত লোকটিকে সিটে শুইয়ে ওর মাথাটা আমার কোলে রেখে ভেঙে যাওয়া হাতটি তুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে যেখান দিয়ে বেশী রক্ত ঝরছিল, সেখানে ব্যান্ডেজ বাঁধার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সঙ্গে সঙ্গে হেলপারকে একটা গামছা জোগাড় করে আনতে বললাম। হেলপারটা কাছেই দাঁড়ানো একজনের মাথায় বাঁধা গামছাটা টান দিয়ে খুলে আমার কাছে নিলে এলো। সিটের নিচে পুরো জায়গাটাই রক্তে ভিজে গেছে তাই হেলপারটা ঠিকমত দাঁড়াতে পারছিল না, তাই আমি ওকে ভাল করে আমার শরীরের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে বললাম। আমার রুমালটা দিয়ে ক্ষতস্থানটা কোনো রকমে ঢেকে তার উপর গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধতে বললাম। হেলপারটি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। সে অতিদ্রুত ক্ষতস্থানে গামছাটি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। আহত লোকটি তখন ভীষণভাবে গোঙ্গাচ্ছিল ও ছটফট করছিল। আমি হেলপারটাকে বললাম, ড্রাইভারকে বল,গাড়ী কোথাও না থামিয়ে সোজা নলকা ঘাটে নিয়ে গিয়ে থামাতে। উল্লাপাড়া, হাটিকুমরুল ইত্যাদি স্টপেজগুলোর যাত্রীরা মৃদু আপত্তি করলেআমি তাদের দৃঢ়কণ্ঠে বললাম,আহত লোকটাকে বাঁচাতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করতে হবে। আপনারা ভাববেন না,আমাদের নলকা ঘাটে নামিয়ে দিয়ে এই বাসটাই আবার ফিরে গিয়ে আপনাদের যার যার স্টপেজে নামিয়ে দিয়ে আসবে। গাড়ীর ড্রাইভার কোথাও না থামিয়ে অতিদ্রুত গাড়ীটা নলকা ঘাটে গিয়ে থামলো। সাহায্যকারী তিনজনকে আহত লোকটিকে ভাল করে ধরে রাখতে বলে আমি তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে ঘাট পাড়ে গিয়ে দেখি, ফেরিটি তখন নদীর মাঝখানে পূর্বপাড়ের দিকে যাচ্ছে। আমি মরিয়া হয়ে চিৎকার করে হাত নেড়ে ফেরি ঘুরিয়ে পশ্চিমপাড়ে নিয়ে আসতে বললাম। ফেরিতে একটি জীপগাড়ী দাঁড়ানো দেখলাম। ভাল করে তাকিয়ে দেখি,সিরাজগঞ্জের এস.ডি.ও সাহেব,সম্ভবত তার নাম ছিল জনাব মাকছুদুল হক, তিনি আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে ফেরির চালককে ফেরি ঘুরিয়ে পশ্চিমপাড়ে নিয়ে যেতে বললেন। ফেরি পশ্চিমপাড়ের দিকে ঘুরতেই আমি ছুটে বাসের মধ্যে গিয়ে হেলপার ও যুবক দু’জনের সাহায্যে আহত লোকটিকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে ঘাট পাড়ে দাঁড়ালাম। ফেরিটা এপারে ভিড়তেই আহত লোকটাকে নিয়ে আমরা ফেরিতে উঠলাম। এস.ডি.ও সাহেব লোকটাকে জীপের পেছনের সিটে তুলে নিতে বললেন। লোকটাকে জীপের মধ্যে তুলে দিয়েই হেলপারটা ও ছেলে দু’টো ফেরি থেকে নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই ফেরিটা ছেড়ে দিল। আমি একা লোকটাকে ধরে রাখতে পারছিলাম না দেখে এস.ডি.ও সাহেব তার গার্ড ও পিয়নকে জীপে উঠে আমাকে সাহায্য করতে বললেন। লোকটা ইতিমধ্যে অনেকটা নিঃস্তেজ হয়ে পড়েছে। আগের মতো দাপাদাপি করছে না। তবে অনবরত গোঙ্গাচ্ছে। রুমাল ও গামছা বাঁধা ক্ষতস্থান থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরছিল। জীপেও আমি ওর মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিলাম। বাকী দু’জন কোমর থেকে পায়ের দিকে ধরে রেখেছিল। ১৫/১৬ মিনিটের মধ্যে জীপটি যতদ্রুত সম্ভব চালিয়ে ফৌজদারি কোর্টের গেটে এসে দাঁড়াল। সাথে সাথে এস.ডি.ও সাহেব গাড়ী থেকে নেমে ড্রাইভারকে সোজা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন এবং আমাকে বললেন,রতু সাহেব আমি অফিসে গিয়ে হাসপাতালে টেলিফোন করে বলে দিচ্ছি। আমরা ১০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে দেখি, হাসপাতালের গেটে ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা স্ট্রেচার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথে নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা অতিদ্রুত অভ্যস্থ হতে আহত লোকটাকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে ছুটলো। আমিও ওদের পিছু নিলাম তখন হাসপাতালের সিনিয়র সার্জন ছিলেন ডাঃ ছানোয়ার হোসেন। তিনি রোগী, ডাক্তার ও নার্সদের নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজা বন্ধ করার পূর্বে আমাকে বললেন,রতু ভাই আপনি ঐ ডাক্তার সাহেবের সাথে অফিস রুমে যান। ডাক্তার সাহেবের সাথে অফিস রুমে গিয়ে পাখার নিচে বসলাম। ডাক্তার সাহেব একজন ওয়ার্ডবয়কে আমার রক্তে ভেজা পাঞ্জাবী ও গেঞ্জিটা ধুয়ে নিয়ে আসতে বললেন। ওয়ার্ডবয়টি আমার কাছ থেকে পাঞ্জাবী গেঞ্জিটা নিয়ে যথাসম্ভব রক্ত ধুয়ে একটি খবরের কাগজের মধ্যে মুড়ে আমার হাতে দিয়ে বলল,এখন আর এগুলো পড়া যাবে না স্যার। ডাক্তার সাহেব তখন ওয়ার্ডবয়টিকে হাসপাতালের একটি ধোয়া পরিস্কার জামা এনে আমাকে দিতে বললেন। তারপর ডাক্তার সাহেব একটি ফরম আমার হাতে দিয়ে সেটা পূরণ করতে বললেন। ফরমটি এক নজর দেখে আমি বললাম,লোক আমার একেবারেই অপরিচিত। ওর নাম ধাম কিছুই জানি না। ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,ঠিক আছে আপনি শুধু ফরমটার নিচে স্বাক্ষর করে দিন। খবর পেয়ে ওর আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চয়ই আসবে। তখন পুরোটা পূরণ করা যাবে। আমি যথাস্থানে স্বাক্ষর করে উঠতে যাব এমন সময় ডাক্তার সাহেব বললেন, আর একটু বসুন। আমি অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে লোকটার অবস্থাটা কেমন দেখে আসি। একটু পরে ঘুরে এসেই বললেন, আহত লোকটার হাত কনুই থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি তবে সার্জন সাহেব বললেন অবস্থা ‘আউট অব ডেঞ্জার’! প্রচুর রক্ত ঝরেছে। ৪/৫ ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। রক্তের গ্র“প খুবই কমন‘এ’ পজেটিভ। এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া চলছে তবে আরো রক্ত ও স্যালাইন দেওয়ার জন্য সাত আট শত টাকা লাগবে। টাকার কথা শুনে তখন আমার মনে পড়ল যে, টাকা ও চেক প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখেছিলাম। তৎক্ষণাৎ সেগুলো বের করে টেবিলের উপর রেখে দেখলাম, টাকা ও চেক রক্ত লাগে নাই। ঠিক সেই সময় এস.ডি.ও অফিসের নাজির সাহেব পৌঁছে বললেন, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এল,আর ফান্ড থেকে এস.ডি.ও সাহেব এক হাজার টাকা আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি টাকাটা নিয়ে ডাক্তার সাহেবের হাতে দিলাম। তিনি একটা পাকা রশিদ আমাকে লিখে দিলেন। নাজির সাহেব এস.ডি.ও বরাবর একটা দরখাস্ত লিখে এনেছিলেন, যাতে আহত লোকটার চিকিৎসা বাবদ এক হাজার টাকার জন্য আবেদন করা হয়েছে। দরখাস্তটাতে আমাকে স্বাক্ষর দিতে বললেন। আমি স্বাক্ষর দেবার পর দরখাস্তটি হাতে নিয়ে তিনি বললেন,আমি এস.ডি.ও সাহেবের জীপ নিয়ে এসেছি। তিনি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে বলেছেন। ডাক্তার সাহেব আমার টেলিফোন নম্বরটা লিখে রাখলেন। আমি হাসপাতালের বেঢং একটা জামা পড়ে নাজির সাহেবের সাথে বেরিয়ে এলাম। নাজির সাহেব আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়েই জীপ ঘুরিয়ে কোর্টের দিকে চলে গেলেন। বাসায় ঢুকতেই ছবি আমাকে দেখেই ভীতভাবে চমকে উঠে বললো,একি অবস্থা! কি হয়েছে তোমার? আমি সংক্ষেপে দুর্ঘটনার কথা বললে ছবি শুধু বললো,কিযে করো না। আমি চেক ও টাকাগুলো তার হাতে দেবার পর ও আমাকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকতে বললো। আমি বাথরুমের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে ছবি আমার লুঙ্গি, তোয়ালে ও বড় একটা তাঁতের গামছা নিয়ে এসে আমাকে দিল। বাথরুমে দুই বালতি ভরা পানি, সাবান ও বসার টুল ছিল। আধঘন্টা ধরে সাবান লাগিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঘরে এসে খাটের উপর বসলাম। ফ্যানটা ফুলস্পিডে ঘুরছিল, সেটা একটু কমিয়ে দিয়ে ছবি পন্ডস্ পাউডারের কৌটা এনে আমার শরীরে ছিটিয়ে দিয়ে তার ছোট্ট হাতের তালু দিয়ে আমার সারা শরীরের সব জায়গায় মাখিয়ে দিল ক্লান্তিতে ঘুম আসছিল। আমি টান টান হয়ে শুয়ে পড়লাম। ছবি বলল,এখন ঘুমিও না। টুনটুনি চা ও রুটি বানিয়ে নিয়ে আসছে, খেয়ে তারপর বিশ্রাম নাও। ছেলে ঢাকা ভার্সিটি হলে, মেয়েরা সবাই আমার চাচাত ভাই বাদশার সাথে যশোরে মিতার বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। চা রুটি খাওয়ার পরেই আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত দশটার দিকে ছবি ডেকে তুলে ভাত তরকারি খেতে দিল। খেয়েই আবার শুয়ে পড়লাম। ছবি আবারও পাউডারের কৌটা এনে আমার সারা শরীরে মাখিয়ে দিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। চোখ মেলেই দেখি সকাল হয়ে গেছে। নাস্তা খেয়ে আবার বিছানায় গড়াগড়ি করছিলাম। ছবি স্কুলে যাবার আগে বলল, আজ বাজারে যেতে হবে না, রওশনকে দিয়ে (স্কুলের নাইট গার্ড) একটা মোরগ ও তরিতরকারি কিনে আনিয়েছি। ১১টার দিকে বাসার টেলিফোনে ডাক্তার ছানোয়ার সাহেব আমাকে হাসপাতালে যেতে বললো। আমি প্যান্ট শার্ট পড়ে স্কুলে গিয়ে ছবিকে বলে হাসপাতালে চলে এলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি অপারেশন থিয়েটারের বারান্দায় গতকালের আহত লোকটার স্ত্রী দুইজন পুত্র কন্যা ও তার ভাই সবাই বসে কান্নাকাটি করছে। আমি সোজা ডাক্তার ছানোয়ার সাহেবের রুমে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,রতু ভাই মাত্র আধাঘন্টা আগে লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। এ্যানাস্থাসিয়ার ঘোর এখনো কাটেনি। অথচ ওর আত্মীয়স্বজনরা এখনি দেখা করার জন্য বড্ড বিরক্ত করছে। তারপর ছানোয়ার সাহেব আমাকে নিয়ে ওদের কাছে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললেন,ইনিই আপনাদের আপনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। না হলে রাস্তাতেই হয়ত মারা যেত। তখন আহত লোকটার আত্মীয়রা আমার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি ওদের বুঝিয়ে বলতেই ওরা অনেকটা আশ্বস্থ হলো। ডাক্তার ছানোয়ার আবার আমাকে অফিস রুমে নিয়ে গিয়ে গাঁটবাধা একটি বড় কাপড়ের বান্ডিল দেখিয়ে বললেন,গতরাতে বাসের হেলপার এসে কাপড়ের বান্ডিলটা দিয়ে গেছে যার মালিক আহত লোকটি। আমি বললাম,লোকটা সুস্থ হলে তাকে বুঝিয়ে দিবেন। আমি ডাক্তার সাহেবকে বললাম,আমি কি অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে লোকটাকে দেখতে পারি? তিনি তখনি আমাকে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে নিয়ে গেলেন। একজন নার্স লোকটিকে ঔষুধ খাওয়াচ্ছিল। ঔষুধ খাওয়ার পর লোকটি আমাকে দেখে তার বা হাতটা একটু উপরে তুলে আমাকে ছালাম জানালো। সার্জন ছানোয়ার অবাক হয়ে বললেন,কি আশ্চর্য! লোকটি আপনাকে ঠিক চিনতে পেরেছে। যাহোক আমি তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে চলে আসার পূর্বে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি, লোকটার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। ব্যথার কান্না না আমাকে দেখে কৃতজ্ঞতায় চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, বুঝলাম না। বাহিরে এসে লোকটি ভাইয়ের কাছে জানলাম, আহত লোকটির নাম আব্দুস ছালাম। বাড়ী উল্লাপাড়ার বাঁশবাড়িয়া তাঁতিপাড়ায়। সে একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী। আমি আবারও আন্তরিকভাবে ওদের আশ্বস্থ করে চলে এলাম। আহত আব্দুস ছালাম হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই স্ত্রী, পুত্র কন্যাসহ আমার বাসায় এসে দেখা করে অনেক কান্নাকাটি করে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেল। এখন তোমাদের কাছে আমার প্রশ্ন সেদিন বাসে এত লোক থাকতে কেন আমি ছুটে গিয়ে লোকটিকে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম? (ক) পুরস্কার পাবার লোভে? (খ) বাহাদুরি দেখানোর জন্য? (গ) নাকি সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা পাবার আশায়? জবাবটা তোমাদেরকেই বুঝে শুনে আমাকে জানাতে হবে। যে এক লাইনের মধ্যে সঠিক উত্তর দিতে পারবে তাকে নগদ পাঁচশত টাকা পুরস্কার দেব। আজকের মত দ্বিতীয় অধ্যায় এখানেই শেষ করছি। (আজ দ্বিতীয় অধ্যায় প্রকাশ হলো)
আশীর্বাদক
তোমাদের ‘আব্বা’
আনোয়ার হোসেন রতু

0 comments:

Post a Comment