Saturday, August 15, 2015

সেই রাতে যা ঘটেছিল

“আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি ...”।
“তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি
আমাকে?” বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে
পারেননি। বাংলাদেশের ইতিহাসের
পাতা থেকে কলঙ্কিত সেই রাতের কথা
সংকলিত করেছেন সুমন মাহবুব।
পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট। ভোররাত।
ধানমণ্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার
আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব
সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে
যান।
যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার বাইরের
বারান্দায় ঘুমিয়েছিল মো. সেলিম (আব্দুল) ও
আব্দুর রহমান শেখ (রমা)।
উপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত
সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে
টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের
বাসায় দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করেছে।
জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে।
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়া
শব্দ না পেয়ে মহিতুল গণভবন (তৎকালীন
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে চেষ্টা
করতে থাকেন।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির
রক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা
উত্তোলন শুরু করা মাত্রই বাড়িটির দিকে
দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়।
একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে
বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ঘুম থেকে ওঠেন
গৃহকর্মী আব্দুল আর রমা। বেগম মুজিবের
কথায় রমা নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে
এসে দেখেন সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি
করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে
এগোচ্ছে।
রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর
গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায়
নামছেন।
দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব
আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা
আর দোতলায় দাঁড়িয়ে না থেকে তিনতলায়
চলে যান এবং বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ
কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম
থেকে তোলেন।
ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পড়ে নিচতলায়
নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল আসেন
দোতলা পর্যন্ত।
রমা দোতালায় শেখ জামাল ও তার
স্ত্রীকেও ঘুম থেকে তোলেন। জামা-কাপড়
পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে
দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে যান।
ওদিকে গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে
বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন
করতে থাকেন মহিতুল।
পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে
চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু
নিজেই বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব
বলছি ...”। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে
পারেননি।
একঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের
দেয়ালে লাগে। কাচের এক টুকরায় মহিতুলের
ডান হাতের কনুই জখম হয়। ওই জানালা দিয়ে
গুলি আসতেই থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের
পাশে শুয়ে পড়েন এবং মহিতুলের হাত ধরে
কাছে টেনে শুইয়ে দেন।
এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর
কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন
বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে
গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত
থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন।
নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে
বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ
সদস্যদের বলেন, “এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা
কী করছ?”
এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু উপরে চলে যান।
‘আমি
শেখ মুজিবের ছেলে’
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল
নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন,
“আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার
সঙ্গে আসেন।” এ সময় শেখ কামালের পেছনে
গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের
ডিভিশনাল সুপারিনটেনডেন্ট (ডিএসপি) নুরুল
ইসলাম খান।
ঠিক তখনই মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন
(ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা
সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে।
গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডস্ আপ’ বলে
চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে
টেনে ঘরের মধ্যে নিয়ে যান নুরুল ইসলাম
খান।
কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে
গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে
লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ
কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, “আমি শেখ
মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি
ওদেরকে বলেন।”
মহিতুল ঘাতকদের বলেন, “উনি শেখ মুজিবের
ছেলে শেখ কামাল।”
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে
লক্ষ করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয়
অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে
মারা যান শেখ কামাল। এর মধ্যে একটা গুলি
মহিতুলের হাঁটুতে আরেকটা নুরুল ইসলামের
পায়ে লাগে।
এ অবস্থাতেই মহিতুলকে টেনে নুরুল ইসলাম
তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তারা
দেখেন, পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্য
দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। অস্ত্রটা তার পায়ের
কাছে পড়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে
ঢুকে বজলুল হুদা সবাইকে বাইরে গিয়ে
দাঁড়ানোর আদেশ দেয়।
‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং’
নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে
পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি দোতলায় তার
ঘরের দরজা বন্ধ করে বিভিন্ন জায়গায় ফোন
করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার
সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান।
তিনি তাকে বলেন, “জামিল, তুমি
তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার
বাসা অ্যাটাক করেছে। শফিউল্লাহকে
ফোর্স পাঠাতে বল।”
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল
শফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি
তাকে বলেন, “শফিউল্লা তোমার ফোর্স
আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে
(শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি
জলদি ফোর্স পাঠাও।"
জবাবে শফিউল্লাহ বলেন, “আই অ্যাম ডুয়িং
সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অফ দ্যা
হাউজ?”
বঙ্গবন্ধুর কথা শোনার পরই কর্নেল জামিল
তার ব্যক্তিগত লাল রঙের গাড়িটি নিয়ে
বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সঙ্গে
ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েনউদ্দিন
মোল্লা। কিন্তু, পথেই সোবাহানবাগ
মসজিদের কাছে তাকে গুলি করে হত্যা করে
ঘাতকরা। পালিয়ে বেঁচে যান আয়েনউদ্দিন।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে
মহিতুল, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, পুলিশের
বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি
করে দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে ঘাতকদের
একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি
করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে যান।
এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে
যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে
আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে।
হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি
সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে
থাকেন।
রক্তে ভেসে যায় সারা সিঁড়ি
বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম
মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা
কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর
ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি
থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায়
বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে।
মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা
বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে।
ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা
কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে মহিউদ্দিন
ঘাবড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা আমাকে
কোথায় নিয়ে যাবি, কী করবি- বেয়াদবি
করছিস কেন?”
এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির
মাঝামাঝিতে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর।
বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু
একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে
সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান
দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
বঙ্গবন্ধুর বুকে ও পেটে ১৮টি গুলি লাগে।
নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকে। সারা
সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে।
‘আমাকে এখানেই মেরে ফেল’
বঙ্গবন্ধুর পেছন পেছন রমাও যাচ্ছিলেন।
কিন্তু ঘাতকরা তাকে ঘরের মধ্যে চলে যেতে
বলে। এর মধ্যে দোতলায় শেখ রেহানার ঘরে
থাকা তার চাচা শেখ নাসের ওই কক্ষে যান।
তার হাতে গুলি লাগার ক্ষত ছিল। রমাই প্রথম
বেগম মুজিবকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা
হয়েছে।
এ সময় ওই ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেন বেগম
মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা
কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের ও রমা।
ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিচে নেমে
এসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার
মোসলেউদ্দিন তাদের সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর
বাড়িতে আসে। আজিজ পাশা তার সৈন্যদের
নিয়ে দোতলায় চলে যায়।
তারা বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে
থাকে। এক পর্যায়ে তারা দরজায় গুলি করে।
তখন বেগম মুজিব দরজা খুলে দেয় এবং ঘরের
মধ্যে যারা আছে তাদের না মারার জন্য
অনুরোধ করেন।
ঘাতকরা বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ
নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে আসতে থাকে।
সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই বেগম মুজিব
কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে
বলেন, “আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে
ফেল।”
রক্তক্ষরণে বিবর্ণ সুলতানা কামালের মুখ
বেগম মুজিব নিচে নামতে অস্বীকৃতি জানান।
ঘাতকরা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে
নিচে নিয়ে যায়। আর, বেগম মুজিবকে তার
ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
বেগম মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর ঘরে আগে থেকেই
অবস্থান নেওয়া শেখ জামাল, সুলতানা
কামাল ও রোজী জামালকে নির্বিচারে
গুলি করে হত্যা করে আজিজ পাশা ও
রিসালদার মোসলেউদ্দিন।
বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায়
পড়ে থাকে। বাঁ দিকে পড়ে থাকে শেখ
জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে
গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায়
সুলতানা কামালের মুখ।
‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’
শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে নিচে
নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরকে সবাইকে সঙ্গে
লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় শেখ নাসের
ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি তো
রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-
বাণিজ্য করে খাই।”
ঘাতকরা একে অপরকে বলে, “শেখ মুজিব
বেটার দ্যান শেখ নাসের।”
এরপর তারা শেখ নাসেরকে বলে, “ঠিক
আছে। আপনাকে কিছু বলবো না। আপনি ওই
ঘরে গিয়ে বসেন।” এই বলে তাকে অফিসের
সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে নিয়ে গুলি করে।
এরপর শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে
গোঙাতে থাকেন। তখন শেখ নাসেরের ওপর
আরেকবার গুলিবর্ষণ করা হয়।
লাইনে দাঁড়িয়ে শেখ রাসেল প্রথমে রমাকে
ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?”
মহিতুল জবাব দেয়, “না ভাইয়া, তোমাকে
মারবে না।” এ সময় শেখ রাসেল তার মায়ের
কাছে যেতে চাইলে আজিজ পাশা মহিতুলের
কাছ থেকে জোর করে তাকে দোতলায় নিয়ে
যেতে বলে।
আজিজ পাশার কথামতো এক হাবিলদার শেখ
রাসেলকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে
হত্যা করে। রাসেলের চোখ বের হয়ে যায়।
আর মাথার পেছনের অংশ থেতলে যায়।
রাসেলের দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা
কামালের পাশে।
এই হত্যাযজ্ঞে ঘরের মেঝেতে রক্তের
মোটা স্তর পড়ে যায়। এর মাঝেই লুটপাট
চালায় ঘাতকের দল।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে
ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর
সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। ছোট বোন শেখ
রেহানাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন তারা।
ঘাতকদের প্রস্তুতি
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার
সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড
রেজিমেন্টের যানবাহনগুলো সচল হয়ে ওঠে।
ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে অবস্থিত ইউনিট
থেকে ১০৫ এমএম কামানগুলোকে ভারি ট্রাক
দিয়ে টেনে নির্মাণাধীন জিয়া
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়
নিয়মিত নৈশ প্রশিক্ষণের জন্য।
রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর
প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪
ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে।
এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক
একত্রিত হয়।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেজর ডালিম, মেজর
নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর
পাশা, মেজর রাশেদ প্রমুখ সেখানে জড়ো
হন।
১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে মেজর ফারুক
অফিসারদের নির্দেশ দেন বিমান বন্দরের
কাছে হেড কোয়ার্টারে স্কোয়াড্রন
অফিসে মিলিত হতে। অফিসারদের
আপারেশনের পরিকল্পনা জানায় মেজর
ফারুক।
তিনিই ছিলেন এ অপারেশনের দায়িত্বে।
প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সরাসরি
আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বাড়িকে
ঘিরে দু’টো বৃত্ত তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, ভেতরের বৃত্তের সদস্যরা
সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করবে।
বাইরে থেকে রক্ষীবাহিনী বা ভেতর থেকে
সেনাবাহিনীর কোনো আক্রমণ এলে তা
ঠেকানোর দায়িত্বে দেওয়া হয় বাইরের
বৃত্তের সদস্যদের। এর দায়িত্ব দেওয়া হয়
মেজর নূর ও মেজর হুদাকে।
ঠিক হয়- তারা ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোড,
সোবাহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজে
রোড ব্লক করবে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর
বাসা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধানমণ্ডিতেই
শেখ ফজলুল হক মণি এবং আব্দুর রব
সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণেরও
সিদ্ধান্ত হয়।
ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সময়
উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেন মেজর ফারুক।
কিন্তু পূর্ব সম্পর্কের অজুহাতে বঙ্গবন্ধুর
বাসায় আক্রমণে উপস্থিত না থেকে
স্বেচ্ছায় সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের
দায়িত্ব নেয় ডালিম।
ভারি মেশিনগান সংযোজিত দ্রুতগতির একটি
জিপে রওনা দেন ডালিম। সঙ্গে এক প্লাটুন
ল্যান্সারসহ একটি বড় ট্রাক।
শেখ মণির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া
হয় রিসালদার মোসলেমউদ্দিনকে। তার সঙ্গে
দেওয়া হয় দুই প্লাটুন সৈন্য।
এক কোম্পানি সেনাসহ রেডিও স্টেশন,
বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউমার্কেট এলাকার
দায়িত্বে থাকে মেজর শাহরিয়ার। একই
সঙ্গে ওই গ্রুপকে বিডিআর থেকে কোনো
ধরনের আক্রমণ হলে প্রতিহত করার দায়িত্বও
দেওয়া হয়।
২৮টি গোলাবিহীন ট্যাংক নিয়ে শের-ই
বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত
করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক নিজে। তবে
ট্যাংকের মেশিনগানগুলোয় প্রচুর গুলি ছিল।
মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
আক্রমণের জন্য ১২টি ট্রাকে সাড়ে তিনশ
সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয়।
সরাসরি আক্রমণে মেজর রশিদের কোনো
দায়িত্ব ছিল না। তার দায়িত্ব ছিল
হত্যাকাণ্ড পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল
দেওয়া এবং সার্বিক রাজনৈতিক
পরিস্থিতি সমন্বয় করা।
তার নেতৃত্বে থাকা ১৮টি কামানে গোলা
ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থার জন্য তৈরি রাখা হয়।
কামানগুলো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার
এবং বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে তাক করা হয়।
একটি ১০৫ এমএম হাউইটজার কামান রাখা হয়
আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনের অধীনে
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে লেকের
পাড়ে।
দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে তাজা
বুলেটদেওয়া হয়। ঘাতকের দল বিমানবন্দর
এলাকা থেকে ভোররাত ৪ টার দিকে
ধানমণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
ফারুকের নেতৃত্বে ২৮টি ট্যাংক বিমানবন্দর
সড়কে বনানীর এমপি চেকপোস্ট দিয়ে
সেনানিবাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে
ফজরের আজান পড়ে যায়।
ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে ৪৬ ব্রিগেড
ইউনিটের লাইনের একেবারে ভেতর দিয়ে
বাইপাস সড়ক ধরে সেনাসিবাসের প্রধান
সড়কে চলে আসেন। ঢাকা সেনানিবাসে সে
সময়ে বিমানবাহিনীর যে হেলিপ্যাড ছিল,
তার ঠিক উল্টো দিকের একটি গেইট দিয়ে
ফারুক তার ট্যাংক নিয়ে বিমানবন্দরের
(পুরনো বিমানবন্দর) ভেতর ঢুকে পড়েন।
এ সময় ফারুককে অনুসরণ করছিল দুটি ট্যাংক।
বাকি ট্যাংকগুলো পথ হারিয়ে জাহাঙ্গীর
গেইট দিয়ে ফার্মগেইটের দিকে এগোতে
থাকে।
ফারুক এয়ারপোর্টের পশ্চিম দিকের দেয়াল
ভেঙে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের
সামনে উপস্থিত হন।
রাত সোয়া ৫টার দিকে মেজর ডালিম ও
রিসালদার মোসলেমউদ্দিনের নেতৃত্বে
আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাসায়
আক্রমণ হয়।
শেখ মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা
করে ঘাতকরা। প্রাণে বেঁচে যান শেখ মণির
ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে
নূর তাপস।
ডালিমের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় আবদুর রব
সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে
বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, চার বছরের
নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে),
ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আবদুল
নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর
হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি
এবং চারজন কাজের লোককে।
দাফন
পরদিন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার আব্দুল
হামিদ বঙ্গবন্ধুর লাশ ছাড়া ১৫ আগস্টে
নিহতদের লাশ দাফন করেন। আব্দুল হামিদ
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে
কফিনে নিহতদের লাশ এবং ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে শেখ মণি ও
আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের
সদস্যদের লাশ সংগ্রহ করে বনানী
গোরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করেন।
বনানী কবরস্থানে সারিবদ্ধ কবরের মধ্যে
প্রথমটি বেগম মুজিবের, দ্বিতীয়টি শেখ
নাসেরের, এরপর শেখ কামাল, সুলতানা
কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, শেখ
রাসেল, ১৩ নম্বরটি শেখ মণির, ১৪ নম্বরটি
আরজু মণির, ১৭ নম্বরটি সেরনিয়াবাতের।
আর বাকি কবরগুলো সেদিন এই তিন বাড়িতে
যারা নিহত হন, তাদের।
১৬ অগাস্ট সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে
করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয়
টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে তাকে দাফন করা হয়
তার বাবার কবরের পাশে। সেনাবাহিনীর ওই
হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট
লেফটেন্যান্ট শমশের আলী।
তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এ এফ এম
মহিতুল ইসলাম, আব্দুর রহমান শেখ (রমা),
মো. সেলিম (আব্দুল), অবসরপ্রাপ্ত
হাবিলদার মো. কুদ্দুস শিকদার,
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল
হামিদ, সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ,
আয়েনউদ্দিন মোল্লা (সোবহানবাগে নিহত
বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল
জামিলউদ্দিনের গাড়িচালক) এর সাক্ষ্য
এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল
আব্দুল হামিদের বই ‘তিনটি সেনা
অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’।

0 comments:

Post a Comment